-->

প্রান্তিক জীবনপটে অনিল ঘড়াইয়ের গল্প বিশ্বে বানজারা সমাজের যাপন চিত্র - চঞ্চল কুমার মণ্ডল

 

প্রান্তিক জীবনপটে অনিল ঘড়াইয়ের গল্প বিশ্বে বানজারা সমাজের যাপন চিত্র  চঞ্চল কুমার মণ্ডল

প্রান্তিক জীবনপটে অনিল ঘড়াইয়ের গল্প বিশ্বে বানজারা সমাজের যাপন চিত্র

চঞ্চল কুমার মণ্ডল

[এক]

নুতন নুতন ভূগোল পথে জীবন খোঁজার লড়াই।

প্রান্তজদের জীবনছবি আঁকেন অনিল ঘড়াই।।

আর পাঁচ জনের থেকে পৃথক অন্য এক ভূগোল, অন্য এক জীবনের সন্ধান দিয়েছেন গল্প-কার অনিল ঘড়াই তাঁর গল্পের ভুবন। যে জীবনে অভাব, সবকিছু বিনষ্ট করে এমনকি যৌবনও। যা প্রমাণিত হয় নিপীড়িত জীবনের মরমি কথাকার অনিল ঘড়াই-এরপথের ফুল-পথের কাটাগল্পের যৌন নিগৃহীতা, সমাজের চোখে বানজারা নারী হিসেবে বিবেচিতা বিন্দিয়ার রক্তিম বেদনাঘন জীবনালেখ্যের মধ্য দিয়ে। গল্পকার ঐ নিদারুণ অভাবগ্রস্ত, সমাজ লাঞ্ছিতা নারী জীবনের নিষ্করুণ কাহিনী চিত্রণে বলেছেনপেটের জ্বালা বড় জ্বালা।' তাই ঐ যাযাবর বৃত্তিধারী বিন্দিয়ারা পথে পথেই ঘুরে বেড়ায়, জঠর নিবৃত্তির জন্যেই। পথই এদের জীবন। কিন্তু এই চলার পথ কুসুমাকীর্ণ নয়, এই পথ কণ্টকাকীর্ণ। এই ভ্রাম্যমাণ জীবন পথে বিন্দিয়াদের উপর যে কোন সময় হামলে পড়তে পারে নারী খাদকের দল। কারণ, চর্যাকারদের সেই চিরায়ত ধ্রুব উক্তি, —“আপনা মাংসে হরিনা বৈরী।তথা, নারীর যৌবন নারীর শত্রু। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে আজও সমাজে চির অটুট রয়েছে নারী জীবনের শোষণ; নারীর যৌন নিপীড়নের মতো নক্কার জনক চিত্র।

এ গল্পের নায়িকা বিন্দিয়া হলেও এই বিন্দিয়ার জীবন চিত্রের পাশাপাশি আরও একটি লাঞ্ছিত নারী তথা বানজারা গোষ্ঠীর দলনেতা রামলালের নাতনি মুন্নির ট্র্যাজেডিঘন জীবনালেখ্য গল্পকার কয়েকটিমাত্র কথার আঁচড়েই খুবই স্পষ্ট ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যে মুনি দেখতে ছিল স্বর্গের হুরি পরীদের মতো। সেই রূপমোহে আসক্ত হয়ে এক সেপাই এসে তাকে থানায় ডেকে নিয়ে যায়। কারণ, ঐ রূপ হল তার কাল। রামলাল মুন্নির পেছন পেছন গেলেও, থানার দারোগা তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি বাইরের বেঞ্চিতে বসিয়ে রাখে। তারপর ঘণ্টা খানিক অতিবাহিত হওয়ার পর তাকে থানা থেকে বিতাড়িত করা হয়। যাওয়ার সময় সে মুন্নিকে নিয়ে যেতে চাইলে তাকে বোঝানো হয়, - ‘তার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত থানায় থাকতে হবে। কী অপরাধ করেছে মুন্নি? এমন প্রশ্ন কিম্ব, কৈফিয়ৎ চাওয়ার মতো সাহস হয়ে ওঠেনি ঐ ভীতু-অসহায় রামলালের। আসলে রামনলালের ধারণার বাইরে মুন্নি যে এখন বাঘের খাঁচার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। গল্পকারের কথায় জানা যায় পর পর খাকি উর্দি পৰা মানুষ তার শরীর খেয়েছে।হাতে গুজে দিয়েছে মাত্র কুড়িটা টাকা। বলেছে- কালই চলে যাবি। আর একদিনও বাড়তি থাকতে দেব না। যদি থাকিস তাহলে তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দেব।' রক্ষকই ভক্ষক। গল্পকার এখানে গোটা বানজারা গোষ্ঠীর চির অসহায় নারীদের দুর্দশার চিত্র, দক্ষ কারিগরের মতো সাহিত্যের পাতায় তুলে ধরেছেন। প্রতিবাদহীন, ভীতু এই গোষ্ঠীর দল নেত্রী ভানুমতী শুধু সান্ত্বনার প্রলেপ দেয় মাত্র। মাথায় সস্নেহের হাত বুলিয়ে নিরুপায় ভানুমতী বোঝায়, -

জীবনে কত কী হয়, সব মানিয়ে নে বিটি৷ আমাদের সংসার নেই, শুধু পথ আছে। পথ ভর্তি কাঁটা আছে৷ ... বাবু জাতটাই খচ্চরের জাত।

এভাবে অসহায় বানজারা গোষ্ঠীর নারী জীবনের উপর পুলিশী নিগ্রহের অতি ঘৃণ্যতম (নক্কার জনক) নারকীয় চিত্র গল্পকার অতি সহমর্মিতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই গল্পের মধ্যে দেখা যায়, লজ্জায়-ঘৃণায়, প্রতিবাদ করতে না পারায় ব্যর্থ যন্ত্রণায় মুন্নি গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। রামলাল বুড়া কান্নায় ভেঙে পড়ে, আপশোস করে বলে

পথের ফুল পথেই ঝরে গেল, এর আর কোনও সদ্গতি হল না। হবে কী করে, যা রাক্ষস মানুষ!

মানুষ যে এমন রাক্ষস হতে পারে, এই প্রথম বুঝতে শেখে বিন্দিয়া। তাই বিন্দিয়া তার চলার পথে মানুষ দেখলেই গা হাড় হিম হয়ে ওঠে। কারণ, বিন্দিয়া জানে শুধু মুন্নিরই নয়, এই

যাযাবর জীবনের যে সুখ তা কেড়ে নিয়েছে ঐ স্থিতু মানুষের দল। ওদের কামনার আগুনে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে হাজার বানজারা রমণীর সতীত্ব।

বিন্দিয়া নিজের চোখেই কাঁদতে দেখেছে তার মা ভানুমতীকে এমনকি ওদের দলের ঐ ঝাটুলালের স্ত্রী লছমিকেও। প্রতিসপ্তাহে তোলা তোলার নামে খাঁকি উর্দি পরা লোভী চকচকে চোখের লালসাময় মানুষেরা এসে, গায়ে পড়ে গল্প জমায়। ওদের পুরুষরা কাজে চলে গেলেই সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁচা বয়সের মেয়ে মানুষদের উপর। চোখে লাগার মতো দেখতে হলেই ওদের সন্ধ্যে বেলায় ডাক পড়ত থানায়। ফিরে আসত ভাের বেলায়। আর পুরুষগুলো কুপি জ্বালিয়ে মড়ার মতো জেগে বসে থাকত তাঁবুতে। ওরা অসহায় - প্রতিবাদহীন হয়ে আক্ষেপে হাত কামড়ায়। চটকানো ফুলের চেয়েও কদর্য চেহারা নিয়ে মেয়েরা ফিরে এসে ঝুপড়িতে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদত। আর ছাউনির পুরুষগুলো হাতের পেশী ফুলিয়ে ব্যর্থ হয়ে, গোখরে সাপের মতো ফুসতে থাকে। গল্পকারের ভাষায়

তবু এর কোনো প্রতিকার হয়নি। কার বিরুদ্ধে লড়বে তারা? এই অসম লড়াইয়ে জীবন হানির আশঙ্কা। তাই দাঁতে দাঁত টিপে সরে গিয়েছে তারা। এছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা নেই। স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ হারিয়ে ওরা এক একটা শুকনো নদী।

এভাবে, গল্পকার অপার সমবেদনার তুলি দিয়ে একটা গোটা বানজারা গোষ্ঠীর সামাজিক শোষণ নিপীড়ন আর, অসহায় ঐ নারী জীবনের সমস্ত রকম বঞ্চনাময় ঞ্ঝাক্ষুব্ধ জীবনের ক্ষত চিত্র এঁকেছেন।

হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও কাহার সম্প্রদায়ের নারীর শোষণ নিপীড়ন আর বঞ্চনার ছবি এঁকেছেন। কাহার সম্প্রদায়ের মানুষেরা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বশীভূত হয়ে থাকতে চায় না। বিত্তশালীদের উৎপীড়ন-বঞ্চনা-নিপীড়নের বিরুদ্ধে, এরা প্রতিবাদও করে না। কাহাররা তাদের মেয়েদেরও সমাজের বাইরে পাঠাতে চায় না। কারণ, মেয়েরা পাছে জাতি চ্যুত হয়ে চলে না যায়। এই উপন্যাসে গ্রামজীবনের অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মেয়েদের জাতিগত অবস্থানটিকে তুলে ধরেছেন। যখন পাগলা, সমাজপতি বনওয়ারীর আদেশ-নির্দেশকে গানের মাধ্যমে বলে:

জাতি যায় ধরম যায় মেলোচ্ছো কারখানা

ও পথে যেও না বাবা, কত্তাবাবার মানা।

বেজাতে দিয়ে জাত যায় দেশান্তরে।

কারখানার বাতাসও মেয়েদের পক্ষে অমঙ্গল জনক৷ এমনকি, রেললাইনের ধারে কাজ করতে গেলেও তাদের জাতি-ধর্ম নষ্ট হয়। তেমনি ভাবে আমাদের আলোচ্য এই বানজারা গোষ্ঠীর নারীদের জীবনও অহরহ দুর্বিষহ হতে দেখা।

দলনেতা রামলাল বুড়া ছাউনির মেয়েদের দুঃখটা বোঝা। তাই কোনো নারী খাদকের কু-নজর টের পেলেই ওরা ঐ ধূর্ত নারী মাংস লোলুপ পশুর হাত থেকে রক্ষা পেতে রাতের অন্ধকারে তাঁবু গুটিয়ে দূরান্তে পাড়ি জমায়। কিন্তু, কতকাল তারা এমন পালিয়ে বেড়াবে? এমন পালিয়ে বেড়ানো জীবনে হাঁফ ধরে গেছে বিন্দিয়ার। তার চোখের সামনে সে মা ভানুমতীকে তুষের আগুনের মতো পুড়তে দেখেছে। মুন্নি-লছমি সহ অসংখ্য বানজারা গোষ্ঠীর নারীদের আর্তনাদ হাহাকার তার কানে প্রতিধ্বনিত হয় বারবার। মা ভানুমতী তাই বিন্দিয়াকে সাজতে দেয় না। আয়না হাতে নিলেই সে ভয়ে শিউরে ওঠে। মেয়েকে তাই সাবধান করে ঝাঁঝের সঙ্গে বলে:

মরবি মুখপুড়ি, মুখে রঙ মেখে খোলা আকাশের নীচে নিজেকে বাঁচাবি কীভাবে?

কিন্তু বয়োজ্যেষ্ঠ রামলাল বুড়া বিন্দিয়াকে কখনো ঐ ভাবে ধোঁকা দেয়নি। কারণ, বিজ্ঞ বুড়া জানে-

সোনা ছাইগাদায় লুকিয়ে রাখলেও মানুষের নজরে পড়ে। যৌবনের তেজ সুরজের তেজের চাইতে কম নয়।

কাহিনী অংশে গল্পকার বিন্দিয়ার রূপসৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-

বালির চড়ার মতো চিকচিকানো গতর। কাজলটানা দিঘল চোখ। গায়ের বর্ণ পাকা গমের, উচ্চতায় ওরা ছাপিয়ে যায় বাবুঘরের বউ, ঝিদের।

এমন অপূর্ব রূপের সৌভাগ্যশীল ঐ বানজারা গোষ্ঠীর রমণীরা। ঈশ্বর কেবল এটুকুই করুণা করেছেন ওদের। কিন্তু তাতে বিপদ বাড়ে বই কমে না, যে কারণে শিল্পীর প্রার্থনা-

যাদের কিছু নেই, তাদের কেন উপরওয়ালা এত রূপ দেয়? আর যদি দেয়, তাহলে রূপ ধরে রাখার হিম্মৎ কেন দেয় না।

এমন যৌবনোচ্ছ্বল রূপ নিয়ে বিন্দিয়া বাধ্য হয় জঠর নিবৃত্তির জন্য পথে পথে ঘুরে বেড়াতে। কারণ, দশবছর আগেই তার বাপ ভানুয়া তাদের ছেড়ে মৃত্যুর কোলে চিরনিদ্রা নিয়েছে। সেই থেকে বিন্দিয়াদের জীবনের জঠর সমস্যা সঙ্কট আরো জটিল হয়ে উঠেছে।

       ওদের ছাউনির ছোট ছোট শিশুরা ঘুরে বেড়ায় রেললাইনের ধারে।

এদের পয়সার বড় অভাব। এই সভ্য সমাজে ওদের দুটো টাকা গুঁজে দেওয়ার কেউ নেই।

এভাবে গল্প শিল্পী খেদোক্তির মধ্য দিয়ে তার অপার সমবেদনার দৃষ্টিতে- এদের জঠর সমস্যার কারণ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে ওদের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের জটিল পদ্ধতিগুলি একে একে চিত্রিত করে দেখিয়েছেন। এদের কেউ কেউ মাদুলি-তাবিজ বেচে জঠরের আগুন নেভানোর চেষ্টা করে কোনো রকম। আবার কেউ বা (বিন্দিয়া) লাল-নীল প্লাস্টিকের ফুল বেচে। মা ভানুমতী ফুলদানী বানিয়ে রেল কলোনিতে বিক্রি করে। শুধু ঐ কলোনি কেন, যেখানেই তাঁবু খাঁটায়- সেখানেই ঐ ফুলের পসরা নিয়ে বসে। প্লাস্টিকের ফুল হলেও ভানুমতীর হাতের ছোঁয়ায় ফুলগুলো যেন প্রাণ ফিরে পায়। ভানুমতীর অমন নজর কাড়া ফুল দেখে বাবু ভদ্রলোকেরা কিনে নিয়ে যায় তাদের ঘর সাজাতে। গৃহহীন এই নারীরা—বাবুদের গৃহ সাজিয়ে তুলতে কতই না বাহারি রঙের ফুল তৈরি করে পরমযত্ন দিয়ে। গল্পের রামলাল বুড়ার কথায়—

হাজার টাকা দিলেও এর দাম দেওয়া যায় না।

ঐ দলের ঝাটুলাল গাছ-গাছালির ওষুধ বিক্রি করে। ওর স্ত্রী লছমীও হরেক কিসিমের পুঁতি কিনে, নিজের হাতে মালা তৈরি করে বিক্রি করত বাবুদের দ্বারে দ্বারে। এদের সবাই এভাবে, কিছু না কিছু বৃত্তি অবলম্বন করে টিকে থাকার লড়াই করে ওরা। বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টায় দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায়। এমন ঠিকানাহীন ভবঘুরে দলের নর-নারীদের অভাব-দারিদ্র্য নিত্য সঙ্গী। এদের অভাব আছে যথেষ্ট, তবু এই বানজারা গোষ্ঠীর ছিন্নমূল চির অসহায় নারীরা অসৎ পথে পা বাড়ায় না। সতীত্ব এদের মূল্যবান গহনারই মতো। শত অভাবের বিষ ছোবলে নীল হয়ে উঠেও এরা কিছুতেই সতীত্বকে   খোয়াবে না। বরং সতীত্বকে সম্বল করে এরা গর্বের সঙ্গ বাঁচতে জানে। তাই এদের দলনেতা রামলাল বুড়ও বোঝা নারীর সতীত্বের কি সাংঘাতিক মূল্য! তাই সে বিন্দিয়াকে সদুপদেশ দিয়ে সচেতন করিয়ে দেয় -ইজ্জোৎ হারাসনে মা, ইজ্জোৎ হারালে আর পাবি না। সত্যিই তাই, নারীর অহংকার তার ঐ সতীত্ব। যা একবার হারিয়ে গেলে আর তা ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। ঐ অশিক্ষিত রামলাল বুড়োরা যা বোঝা, শিক্ষিত সমাজ তা বোঝা না। কিম্বা, বুঝেও না বোঝার ভান করে। অভাবী, গরীব মানুষেরও যে ইজ্জৎ আছে তা এরা স্বীকার করতে নারাজ। তাদের চোখে মাটি ঘেঁষা মানুষের জীবনে এর কোনো মূল্যই নেই। তাই তো ঐ শিক্ষিত সমাজের দিকে আঙুল তুলে রামলাল বুড়ো বলতে বাধ্য হয়েছে

এ সমাজটা ভাল নয়, ওরা শিকড় উপড়ানো মানুষদের কাঁচা মাংস চিবিয়ে খেতে ভালবাসে।

আর তাই প্রমাণ হয়ে যায় গল্পের একেবারে Climax পর্যায়ে পৌঁছে বানজারা রমণী বিন্দিয়ার সংগ্রামমুখর জীবনালেখ্যের মধ্য দিয়ে।

[দুই]

বিন্দিয়া অশিক্ষিত হলেও বাস্তব সমাজ ও সংসার সম্পর্কে সে ছিল যথেষ্ট অভিজ্ঞ। মা ভানুমতী কয়েকদিনের জ্বরে যখন একেবারে নাস্তানাবুদ অবস্থা, দুর্বল শরীর নিয়ে যখন বাইরে বেরােতে আর পারছে না। তখন লোভ বশত মেয়ের কাছে বায়না ধরে কোকড় লাগা মুরগির মাংস খাওয়ার। বয়স বাড়লে যা হয়। তাছাড়া, জ্বরজ্বালা থেকে উঠলে মানুষের নোলা বাড়ে। মায়ের পছন্দের খাদ্য মুখে তুলে দিতে বিন্দিয়া প্লাস্টিকের ফুল নিয়ে পথে পথে ঘোরে বিক্রির আশায়। কিন্তু, একটাও ফুল বিক্রি হল না তার। এদিকে অকস্মাৎ বৃষ্টি আসায় রাস্তা প্রায় ফাঁকা। দু-এক জন ছাতা মাথায় দিয়ে ব্যস্ত পায়ে নিরাপদ গন্তব্যে ফিরে যাচ্ছে। নিরুপায় বিন্দিয়া শেষ পর্যন্ত পথ ছেড়ে দোকানে দোকানে ফেরে। কিন্তু, দু-পাঁচটা দোকান ঘুরেই সে স্পষ্ট বুঝতে পারে এ ফুল কেউ কিনবে না। আসলে

ওরা প্লাস্টিকের ফুল নয়, রক্ত-মাংসের বিন্দিয়াকে কিনতে চায় উচ্চ দামে।

অনেকের নোংরা খিস্তি-খেঁউড়, আকার-ইঙ্গিত বিন্দিয়ার কাছে যা স্পষ্ট করে তুলেছে। কিন্তু, কেমন করে সে তার মায়ের ঐ সামান্য সখ-আহ্লাদ মেটাবে? এপ্রসঙ্গে নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীরদেবীনামক একাঙ্কিকার নাট্য ঘটনাটি স্মরণে আসে। যে নাটকের এক নিদারুণ অভাবগ্রস্ত বাউরী মেয়ে তার শাশুড়ির সামান্য সখ-আহ্লাদ মেটাতে বাঘের ভয় তুচ্ছ করে রাতের অন্ধকারে ডাকবাংলোয় বাৰুদের বাসায় ছুটে যায় মাত্র দু'টা টাকার জন্য। যে দুটাকায় বুড়ির নেশার জন্য বিড়ি আর, আখা কিনতে সে চায়। কারণ শুখনি জানে, একসময় ঐ বুড়িও তাদের ভরন-পোষণের সব দায়-দায়িত্ব মাথা পেতে নিয়েছিল। আজ সে বয়স ভারে জর্জরিত। খাটতে পারে না। তাই, অতীতের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে; বুড়ির সামান্য সখআহ্লাদ মেটাতে রোজগারের ধান্দায় নেমে, তখনি বাঘের মুখে পড়ে মৃত্যু বরণ করে। যখন তাকে উদ্ধার করা হয়, তখনও তার হাতের মুঠোয় বাংলোর বাবুদের দেওয়া ভিক্ষার দুটা টাকা রক্তে রেঙে উঠেছে। ঐ অঞ্চলের লোকেরা বাঘকেদেবীবলে। কিন্তু, নাট্যকারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এবং জীবনের প্রতি সুতীব্র আন্তরিকতায় ঐ বাঘ নয়, বৃদ্ধা শাশুড়ির প্রতি পরম কৃতজ্ঞতা বশত: জঠর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া ঐ সামান্য বাউরী মেয়ে শুখনিই প্রকৃত দেবী। তেমনি, এই গল্পের চির অভাবী নারী বিন্দিয়া ও মায়ের সামান্য লোভ রিপু মেটাতে; নিরুপায় হয়ে পথের বেড়ার ধারে ঝিম মেরে বসে থাকা মরগিটাকে খপ করে ধরে ফেলে। লোকচক্ষুর আড়াল করতে ঘাড় ধরে মুচড়ে দেয়। ডানা ঝাপটিয়ে নিথর হয়ে গেলে পর, তলপেটের ভেতর কায়দা করে ঢুকিয়ে পথ হাঁটে। কিন্তু, মুরগির মালিক বুঝতে পেরে প্রকাশ্য দিবালোকে তার চুলের মুঠি চেপে ধরে। তারপর ঝৗকাতে ঝাঁকাতে ঠেলে দেয় শক্ত খোয়ায়। যেমন করে ঐদেবী' নাটকের বাউরী মেয়ে শুখনিকেও বাঘে ধরে টানাহ্যাঁচড়া করে। কিন্তু, তাতেও শুখনি হাতের মুঠোয় দুটি টাকা শক্ত করে চেপে ধরে রাখে। প্রাণ বেরিয়ে গেলেও কিছুতেই তা সে খোয়ায় না। অথচ অনিল ঘড়াইয়ের গল্পের ঐ চির অসহায় নারী বিন্দিয়া তা পারে না, ঘাড় ধাক্কা খেয়েই পেটের ভেতর লুকিয়ে রাখা ঘাড় মটকানো মুরগিটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। লজ্জামাখা যন্ত্রণায় দুচোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ে। লোকটির কটুক্তিময় বিষ মাখানো কথা বিন্দিয়া দেহ মনকে উথাল-পাথাল করে তোলে।

ওদের মতো চোর আর দুনিয়ায় নেই। ওরা দিনের বেলায় সাধু সেজে রাতের বেলায় সিঁদ কাটে। মুখ দেখে বোঝাই যায় না এত শয়তান৷ নিরীহ মুখগুলোই শয়তানের বাসা। ওদের উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার। ...

অভাবে যে স্বভাব নষ্টএকথা ভদ্র সমাজের সভ্য মানুষেরা বোঝার চেষ্টা করে না। অভাবই এদের বাধ্য করেছে ঐ পথ বেছে নিতে। 'বানজারা সমাজের সবাই যে চোর এমন নয়।অভাব রোগে সকলেই কেনস্বভাব দোষের বদনাম পাবে? তাই ঐ কথাগুলো বিন্দিয়ার কানে যেন বিছের হুল ফোটায়। মনে পড়ে তাদের দলের প্রতি রামলালের নির্দেশ -চুরি চামারি করলে দল থেকে ভাগিয়ে দেব। একবেলা খেও, সেও আচ্ছা; কিন্তু পরের দোরে সিদ কেটে নয়। তাহলে এবার সে কী জবাব দেবে রামলাল বুড়াকে? মা ভানুমতি শুনলে তো কপাল চাপড়ে কাঁদবে। মুরগির মালিকও বিন্দিয়াকে সহজেই ছাড়ে না। সে নাকি ডিম পাড়া মুরগিটাকে মেরে ফেলেছে। এত ভাল জাতের মুরগি নাকি সচরাচর দেখা যায় না। সুতরাং বিন্দিয়ার শত কাকুতি-মিনতি সত্ত্বেও কোনো ক্ষমা নেই। তাকে ঘিরে ভিড় জমে ওঠে৷ অসহায় বিন্দিয়াকে দেখে সবাই যেন এরকম মজা লুটছে। ভিড়ের মধ্য থেকে কে-যেন ধারালো বাক্য বাণ ছুঁড়ে দেয়

শালারা সব চোরের জাত। এরা দিনের বেলায় মাল দেখে যায়, রাতের আঁধারে সটকে নেয়। বড় ডেঞ্জারাস!

বন্দিয়াকে আর থানায় ধরে নিয়ে যেতে হল না, পাড়ার পুলিশটা ভুড়ি দুলিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল। বিন্দিয়াকে সে তোলা তুলতে গিয়ে বার দুই দেখেছে। স্টেশনের ধারের মাঠটায় ছাউনি গেড়েছে ওরা। পাখি ফাঁদে পড়েছে; তাই উল্লাসে উড়ি নাচিয়ে-লাঠি নেড়ে বলে, - ছেড়ে দিন, এর ব্যবস্থা আমিই করব।' বিন্দিয়া একহাত থেকে আরেক হাতে চলে যায়। বিন্দিয়া লক্ষ্য করে, পুলিশটার ধূর্ত চোখের বাঁকা হাসি। সে মুক্তির আশায় ঐ বাবুকে অনেক কাকুতি-মিনতি করে। কিন্তু কোনো লাভ হল না। বরং উল্টে শর্ত সাপেক্ষে তাকে কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি দেয়। বিন্দিয়াকে শপথ করিয়ে নেয়, সন্ধ্যে বেলায় যেন সে এসে সিপাইবাবুকে খুশি করে। আর যদি না আসে, তাহলে যে কতখানি ভয়ঙ্কর বিপদ তাদের আছে সে সম্পর্কে সাবধান করে দিয়ে বলে, -

না হলে এখানকার নুনভাত তোদের গোটায়।

বাড়ি ফিরে চিন্তায় গোঁ মেরে বসে থাকে বিন্দিয়া। মুখে খাবার তুলতে পারে না সে। ভানুমতী মেয়ের গোমরা মুখ দেখে কিছু জানতে চাইলে; বিন্দিয়া মাকে বলে, -

এখানে আর মন ধরছে না, এবার যেতে পারলে বাঁচি।

রমলাল বুড়া তার কথা শুনে বলে:

এখানকার পুলিশের খাই বড় কম৷ হাতে তুলে যা দেবে তাই নেবে। জায়গাটা সবার মনে ধরেছে। বাড়তি কদিন থেকে গেলে মন্দ কি?

উত্তরে বিন্দিয়া মুখ খুলে বলতে পারে না আসল ঘটনাটা কি! সে শুধু এক ঘোর বিপদের আশঙ্কা অনুভব করে সবাইকে বোঝাতে চায়, তাদের সামাজিক অবস্থানটা কতখানি কন্টকাকীর্ণ।

সবজায়গায় সমান। বানজারাদের আবার ভালোমন্দ!

এই বলে সে শেষ পর্যন্ত মা ভানুমতীকে জানায় সন্ধ্যায় তাকে সেপাইবাবু থানায় ডেকেছে। না গেলে সমস্ত বিপদের কালোমেঘ তাদের পুরো ছাউনি ঘরে এসে হুমড়ে পড়বে। গিয়ে যে আর কোনো উপায় নেই। একবার যখন তার উপর দৃষ্টি পড়েছে তখন না গেলে ছাউনিতে এসে সব তছনছ করে দেবে। ভানুমতী তার দীর্ঘ জীবন অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝে গেছে তাদের জীবন কতখানি সংকটপূর্ণ। তাই নীরবে চোখের জল ফেলেও নিজ হাতে মেয়েকে সাজিয়ে দিয়েছে। মেয়ে বড় হয়েছে, তাই পেটের ভাত তাকেও তো জোগাড় করতে হবে। কতদিন এভাবে মেয়েকে সে আগলে রাখতে পারবে? ‘ন্যাসাবাগদি শেয়াল ধরতে যায়গল্পের নাসারও মেয়ের জন্য উৎকণ্ঠা –

সর্বত্র ক্ষেপা শেয়ালের গন্ধ, তোরে কেমনে বাঁচাই বলতো?

মুন্নিও এভাবে থানায় গিয়ে একাধিক পুলিশের দ্বারা ধর্ষিতা হয়ে শেষে লজ্জায় ঘেন্নায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে মৃত্যু বরণ করে। তাই, রামলাল বুড়া মুন্নির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে - বিন্দিয়ার বদলে বৃদ্ধ ভানুমতীকে পাঠায়। কিন্তু ভানুমতী জানে, তাকে নয়; ওরা ফুটন্ত ফুল বিন্দিয়াকেই চায়। তাই বিন্দিয়াকে না পেয়ে সেপাইটি গর্জে ওঠে। এমনকি, ছাউনিতে তাকে খুঁজতে আসে৷ না পেয়ে রামলাল বুড়াকে বেদম প্রহার করে। বিন্দিয়া পাকুড় গাছের ডালে লুকিয়ে বসেছিল। সবিই ঐ রামলাল বুড়ার নির্দেশ। তাকে নিষেধ করেছিল, যতক্ষণ না ভানুমতী ফিরে আসছে - সে যেন গাছ থেকে না নামে। কিন্তু একটা নিরীহ বৃদ্ধ মানুষ এভাবে তার জন্য শুধুশুধু মার খেয়ে যাচ্ছে দেখে, সে আর না সইতে পেরে ঐ পাকুড় গাছের ডাল থেকে নেমে এসে শুধায়

চলো সেপাই বাবু, কোথায় নিয়ে যাবে আমায়। কথা যখন দিয়েছি তখন আর বিলচুহার মতো পালিয়ে বেড়াব না। বানজারাদের কথার কোনও দিন নড়চড় হয় না।

এই বলে সেপাই বাবুর পেছন পেছন হাঁটতে থাকে বিন্দিয়া। এ সময় তার শুধু মুন্নির জীবনের পরিণামের কথাই নয়, তার মা ভানুমতীর কথাও মনে পড়ে। ফুলের মতো সুন্দর ছিল সে। তবু পথের ফুল বলে সবাই তাকে মাড়িয়ে গেল; এই মাড়িয়ে যাওয়াটাই বিন্দিয়ার মোটেই পছন্দ নয়। তাই সে থমকে দাঁড়িয়েসেপাই বাবুকে শুধায় বিয়ে হয়েছে কি না। সেপাইটি নির্লজ্জের হাসি হেসে উত্তর দেয় – 'শাদি হয়নি বলেই তো তোদের কাছে আসা।' নিশ্চিত হয়ে বিন্দিয়া এবার জানতে চায় সেপাইবাবুর তাকে পছন্দ কি না। হ্যাঁ সম্মতি পেয়ে বিন্দিয়া তাকে হাত ধরে ঘরে তোলার কথা বলে। কারণ, তাদের এই পথের জীবন বড় এলোমেলো। তার মা মুখে কালি মেখেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি ঐ নারী খাদকদের হাত থেকে। তাই সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়

তোমার মতো বাবুরা তাকে (মা ভানুমতীকে) চা বানিয়ে। খেয়েছে। আমি কারও চানা হতে চাইনে সেপাই বাবু, তুমি আমাকে মাথা গোঁজার আশ্রয় দাও!

লোভী-ধূর্ত ঐ কামার্ত লোকটি বিন্দিয়ার এমন প্রস্তাবে কোনো মতেই সম্মত নয়। এরা কেবল ভোগ করতেই জানে। নারীকে সম্মান করতে শেখেনি কোনো দিন। নারীর সামাজিক মশাল এরা দিতে জানে না। সে সাহসটুকুও এদের নেই৷ কেবল পথের ফুল মনে করে এদের ম যেতে আনন্দ পায়। তাই, বিবেকহীন-অকৃতজ্ঞ, দুকান কাটা পুরুষের উত্তর-

পথের কুকুর ঘরে বেঁধে রাখলে লোক হাসে। আমি কারও হাসির। কারণ হতে পারব না।

এদের আবার সামাজিক লোক-লজ্জার ভয়; অথচ নারীর কাছে নির্লজ্জ হতে এদের দ্বিধা মাত্র নেই। বিন্দিয়া তাই ফিরিয়ে দিতে চাইলে লোভী লোকটি তাকে ছাড়তে চায় না। অন্য পুরুষকে তার উপযুক্ত শাস্তি দিতে বিন্দিয়া মনে মনে প্রস্তুত হয়। নিজেকে বিকিয়ে দেওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বিন্দিয়া বুকের ভেতর থেকে সন্তর্পণে বের করে আনে চাকু।

ভানুমতি যা পারেনি, মুন্নি যা পারেনি, অবলীলায় চোখের পলকে সেই অঘটনটা ঘটিয়ে ফেলে সে। অন্ধকারে কাতরাতে থাকে সেপাই বাবু। রক্তে ভেসে যায় তার যুগল থাই - যা এতদিন কেবল মুন্নাদেরই শোভা পেত।

 দ্বিখণ্ডিত পুরুষাঙ্গ তার হাতের মুঠোয়, তখনও রক্ত চুয়ায় ফোঁটা ফোঁটা। মেয়ের ধাবমান উন্মাদিনী শরীরের দিকে তাকিয়ে ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ভানুমতি; - ‘বিটিরে গলায় ফাঁস নেওয়া মহাপাপ। আয় মা, কাছে আয়। মুন্নির মতো তোকে যে আমি হারাতে চাইনে। মায়ের আবেগী আহ্বানে বিন্দিয়া ঘুরে দাঁড়ায়। মনকে সে শক্ত করে বলে

 আমি বাচতে চাই মা, আমি বাচতে চাই।

পথের ফুল হয়ে বাঁচতে চাই।

       পথের ফুল ঐ লছমি-মুন্নি-ভানুমতীদের চলার পথকে পিছল করে দিলেও; বিন্দিয়াকে কিন্তু দলে-পিষে মাড়িয়ে যেতে পারেনি ঐ নারী মাংস লোলুপ, কামার্ত পুরুষেরা। পথের কাঁটাকে উপড়ে ফেলার সাহস রেখেছে বিন্দিয়া একাই। সে প্রমাণ করে দিয়েছে, তারা বানজারাসমাজের নারী হলেও; পথের ফুল ভেবে (অসহায়-দুর্বল ভেবে) ভুল করে ভবিষ্যতে কেউ আর তাদের এভাবে মাড়িয়ে যাওয়ার সাহস পাবে না।

গল্পের মধ্যে যৌন নিগৃহীতা নারী ভানুমতীর জীবনালেখ্য বিন্দিয়ার সংগ্রামী জীবন চিত্রের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠলেও; কয়েকটি মাত্র কথার আঁচড়েই সজীব রূপে ফুটে উঠেছে লাঞ্ছিতা নারী লছমির রক্তিম-বেদনাবহ জীবন ছবির ভেতর দিয়ে। বনফুলেরশিককাবাবনাটকেও ঐ রূপ যৌন নিপীড়িতা নারী সৌদামিনীর জীবন সংকট অনুরূপ ভাবে লক্ষ্য করার মতো৷ সৌদামিনীর দূর সম্পর্কের মামা তাকে বিক্রি করে দেয়। বহু পুরুষের কমনার শিকার হয়ে হাত বদল হতে হতে শেষে পান্নালাল নামে এক লম্পট পুরুষের হাতে এসে পড়ে সে। পর্দার আড়ালে তাকে বসিয়ে রেখে কয়েকটি কামার্ত, নারী মাংস লোলুপ পুরুষ সেখানে জড়াে হয়ে মশলা মাখানো কাবাব খেতে খেতে মদ ভরতে থাকে গ্লাসে। সৌদামিনীকে পাওয়ার জন্য তারা অধৈর্য হয়ে ওঠে। এরই ফাঁকে নাট্যকার নিস্তারিণী নামে এক ধর্ষিতা নারীর অপমৃত্যুর দৃশ্য ফুটিয়ে তোলেন কয়েকটি মাত্র সংলাপেই। যেমন করে এই গল্পের বিদ্রোহিণী প্রতিশোধ স্পৃহা নারী বিন্দিয়ার সংগ্রাম সংকল্প লড়াকু জীবন চিত্রের ভেতর দিয়ে ধর্ষিতা নারী লছমি-মুন্নির জীবন ছবি ফুটে উঠেছে স্বল্প কয়েকটি কথার আঁচড়ে। শিককাবাবএকাঙ্কিকার নারী সৌদামিনী, নিস্তারিণীরা নিরুপায় হয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার দ্বারা মুক্তির পথে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। তেমনি আলোচ্য গল্পাংশেও ধর্ষিতা নারী লছমি-মুন্নিরা আত্মহত্যা করে মরে বেঁচেছে। ভানুমতী মরেনি। কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে সে বাঁচার সংগ্রাম করে গিয়েছে। কিন্তু প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারেনি, গোটা বানজারা সমাজের নারী বিন্দিয়া একাই পেরেছে তাদের নারী জীবনের ধিক্কার জনক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ যথার্থ প্রতিশোধ নিতে। তাদের ঐ ভ্রাম্যমাণ জীবনে চলার পথের কাঁটাকে সে উপড়ে ফেলতে পেরেছে একা হাতেই। ঐ বিকৃত ক্ষুধার লম্পট পুরুষদের বিষদাঁত ভেঙে, তাদের থমকে দিতে পেরেছে ঐ বানজারা সমাজের সাহসী নারী বিন্দিয়া। গল্পকার অনিল ঘড়াইয়ের লেখনীর বলে বলিয়ান, এই অসহায় প্রান্তিক রমণী বিন্দিয়া যথার্থ অর্থে বিদ্রোহিণী নারী। সে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েরহারানের নাত জামাই' গল্পের বিদ্রোহী নারী ময়নার মার সমকক্ষ। যে ময়নার মা পুলিশী নিগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ঝাঁটা-বটি হাতে রুখে দাঁড়াবার স্পর্ধা দেখিয়েছে। তেমনি, বিন্দিয়াও পুরুষের বিকৃত ক্ষুধার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানর মধ্য দিয়ে সে কথা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন গল্পকার। মহুয়াকেও বহু পুরুষের কামনার অগ্নিবাষ্প থেকে রক্ষার জন্য মরণপণ লড়াই করতে হয়েছে। কথাশিল্পীরঅক্ষর মালা পর্যায়ের প্রথম পর্বের গল্প - খাদ্য-খাদক'এর মধ্যেও নারী পুরুষের এমনই খাদ্য-খাদকের সম্পর্কের কথা লেখকের কলমের ডোগায় উঠে এসেছে। খিদের জ্বালায় স্টেশন চত্বরে ঘুরে বেড়ানো ভিখারি কিশোরী সরাে ও বুলির দিন যাপনের গ্লানি এই গৱে প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে। যা, নগ্ন অথচ বাস্তব সত্য। ঐ অসহায় ক্ষুধার্ত নারীদের ভোগ করার জন্য বিকৃত শিশ্মের ক্ষুধা নিয়ে কামার্ত পুরুষেরা পরস্পর মেতে ওঠে। লম্পট রামু, কালু ও চুন্নীর উদগ্র কামনা নগ্ন ভাবে প্রকটিত হয়ে ওঠে, - ওদের পরস্পরের নির্লজ্জ কথা বার্তায়।

রামুর দাবি, -কালু, মাল আমি একা ফিট করেছি। আমি একা খাব।

কালুর দাবি, - স্টেশনের মাল। তুই একা খাবি মানে? আমার ভাগ চাই।

চুন্নীরও আর তর সইছিল না; সে রামু-কাল্লুর বাক্‌ যুদ্ধের কাড়াকাড়িকে উপেক্ষা করে - ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের মাঝখানে। তারপর বলে, -

গাছের ফুল কারোর একার নয়, সবার। আমাকেও গন্ধ শুকতে দিতে হবে৷ না হলে ফাটাফাটি হয়ে যাবে।

এভাবে, ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নারীকে পুরুষেরা চিরকালভোগের মালমনে করে। তবুও যৌন নিপীড়িতা, চির অসহায় নারী ঐ বুলিরা এর প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠার স্পর্ধা রাখে। বাস্তবে তা সম্ভব কি না, জানি না। হয়তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। কেবল, পূর্বালোচ্য গল্পের বিন্দিয়ার মতো, এই গল্পের বুলিরা মাঝে মধ্যে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার স্পর্ধা রাখে মাত্র। নইলে কেন এই গৱে লেখক (খাদ্য-খাদক) সামাজিকতার দায় হিসেবে, ধারা ভাষ্যের ভঙ্গিতে বুলির সাহসিকতাপূর্ণ বিদ্রোহিণী নারী মূর্তির ছবি ফুটিয়ে তুললেন? –

অবজ্ঞা ভরে একটা গোড়া কাটা পুরুষাঙ্গ বুলি ছুঁড়ে দিল সরোর দিকে। দাঁতে দাঁতে ঘষে সে বলল, কাল তোকে (সরোকে) যারা তাবিয়ে দিয়েছিল, আজ তাদের তিনজনকে আমি হারিয়ে দিলাম। কাল্প প্রথমে এল। আমি বাধা না দিয়ে আসল কাজটা করে দিলাম - হাতের রক্ত শাড়িতে মুছে বুলি স্টেশনের ঘেয়ো কুকুরটাকে ডাকল আদর করে, ‘আয় তু! তুতু। এই নে মাংস।' বুলি পুরুষাঙ্গটা ছুঁড়ে দিতেই ঘেয়ো কুকুরটা নিমেষে ওটা দাঁতে করে তুলে নিয়ে অন্ধকারে চলে গেল।

এরূপ অনিল ঘড়াইয়ের অসংখ্য গল্পে নারীর শোষণের, নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার মতো, অদম্য শক্তি ধারিণী সাহসিকাপূর্ণ জীবন্ত ছবি রয়েছে যত্র-তত্র। যে ছবিগুলির মধ্য দিয়ে অত্যন্ত সহজ ভাবে ধরা পড়ে কথাশিল্পী অনিল ঘড়াইও যেন নারী জীবনের ঐ শোষণ হাহাকারকে চিরতরে মুছে দিতে সত্যের কাছে দায় বদ্ধ। সাহিত্যের মঙ্গল ঘট প্রতিষ্ঠায় শাশ্বত মানব জীবনের প্রতি তিনি ভীষণ ভাবে অঙ্গীকার বদ্ধও।

বানজারা সমাজের সংকটময় যাপন চিত্রের মধ্য দিয়ে ছোটগল্পের নামকরণটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ ও সর্বাঙ্গীণ ভাবে সার্থক হয়ে উঠেছে। গল্পের ছত্রে ছত্রেপথের ফুল' হিসেবে গল্পশিল্পীর সমবেদনার তুলিতে ফুটে উঠেছে ঐ বানজারা রমণীদে সংকটঘন ছবি। আবার ঐ ভ্রাম্যমাণ গোষ্ঠী জীবনের চলার পথে, - লোভী-কামার্ত পুরুষেরা তাদের পথের কাঁটা' হিসেবে উঠে এসেছে। যখন এরা আক্ষেপের সুরে বলে,--

আমাদের সংসার নেই, শুধু পথ আছে। পথ ভর্তি কাঁটা আছে।

এই পথের কাঁটাযে, ঐ বিকৃত ক্ষুধার লোভী কামার্ত পুরুষেরা তা আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি, যা নামকরণের তাৎপর্যতাকে সার্থক করে তুলেছে। আবার ঐ বানজারা গোষ্ঠীর ধর্ষিতা রমণী মুন্নির আত্মহত্যা প্রসঙ্গে রামলাল বুড়ার আক্ষেপের মধ্য দিয়েও গল্পের নামকরণটি সর্বাঙ্গীণ সার্থকতা লাভ করেছে। যখন রামলাল বুড়া আক্ষেপের সঙ্গে বলে, -

পথের ফুল পথেই ঝরে গেল, এর আর কোনও সদ্গতি হল না।

স্বভাবত কারণে গল্পের নায়িকা বিন্দিয়া তাদেরই ঠিকানাহীন ভ্রাম্যমাণ জীবন ছেড়ে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল, সিপাইবাবুর কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করেছিল। কিন্তু ধূর্ত লোভী ঐ কামার্ত সিপাইবাবু তাকেও মুন্নির মতোপথের ফুলভেবে ঝরিয়ে দিতে চেয়েছিল। অথচ মুন্নির মতো বিন্দিয়া নিজেকে ঝরিয়ে দেওয়ার সুযোগ দেয়নি। বরং সে ঐ পথের কাটাকে চির তরে উপড়ে ফেলার সাহস দেখিয়েছে। এভাবে গল্পের ঘটনা তরঙ্গেপথের ফুল-পথের কাটা' কথাটি বার এসেছে যা গল্পের নামকরণকে তাৎপর্যপূর্ণ ও সর্বাঙ্গীণ সার্থকতা দান করেছে।

গল্পের মধ্যে উপমিত ভাষা নির্মাণ দক্ষতা, গল্পকারের কবি মনের পরিচয় বহন করে। কোনো কোনো উপমায় চিত্রকল্প লক্ষ্য করার মতো।

১। বিন্দিয়ার টিকালো নাকের উপর ফুটে উঠেছে ঘাসফুলের চেয়েও গুড়ি গুড়ি ঘাম।

২। অপমানের ঐলি বিষ দুচোখে ফুটিয়ে দেয় অপরাজিতা ফুল।

৩। মুন্নির সাপ বিনুনি চুল পিঠের বিছানায় শোয়ানো

৪। এখন যাঁতাকলের দরের চেয়ে করুণ মুখ বিন্দিয়ার।

৫। এলোমেলো হাওয়ার পাকুড় গাছের পাতা কাঁপছে। নতুন, ভেল চকচকিয়া পাতাগুলো বিন্দিয়ার লাবণ্য ভরা মুখের মতো

আবার, অনেক উপমিত বর্ণনায় নীতিকথনও ফুটে উঠেছে যেমন-

যৌবনের তেজ সুজের তেজের কম নয়।

গর মধ্যে লোকায়ত মাতিৰ ধন ফুটিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে তী সাহিত্যে মল ঘট প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় বার বার।

...নজরটারে উঁচা রাখে। নজর ছোটো হলে মানুষ যে তলিয়ে যায়।

এইরূপ তাঁর প্রতিটি গল্পের ক্ষেত্রে ভাষার মধ্যে, অসংখ্য লোকায়ত নীতিকথাধর্মী উক্তি ক্ষ করার মতো। যা, তাঁর কন্যাশিদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসম্ভব রকম আলোক-দুতি বিশেষ। যে কথাশিল্পের আলো, হিতপ্রায় মানব কল্যাণের শিল্পলব্ধ প্রচেষ্টায় স্থান লাভ করেছে। যা, তাঁর কথাশিল্পের যত্র-তত্র ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মণি-মুক্তা বিশেষ, যে মণি-মুক্তাগুলি অক্ষর শিল্পীর মূলাবান গহনারই মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ লোকজীবন থেকে সংগ্রহ করে নি শিল্পে সুযোগ ঘটিয়েছেন তিনি। ফলে তাঁর কথাকলায় আলোকিত ভাষা এত প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠেছে।